‘ঘুটে’ পাওয়া একখণ্ড শীতল জল
দীপ্ত উদাস
বাম-বুকের জমাট ‘ব্যথা’টি একান্ত ইচ্ছাকৃত, কিংবা কখনো সখনো মনে হয় নিবিড় অবহেলা, অনুমান গঠনের পরিসংখ্যানে বেশি ভোট পড়ে সঙ্গ নির্বাচনে, নিকোটিন, হাইড্রোক্যাফেইন অনেককাল যাবৎ বুকে বাসা বাঁধতে আরম্ভ করে— নিপুণ করে, এমন আপন কারুকার্যময়তা কেবল প্রত্যাশাহীন প্রেমিকের প্রতিশোধ ছাড়া কখনো ভিন্ন কিছু মনে হয়নি, নাকের নিচের আন্ডার লাইনের রেশ যখন বেশ ঘনো হতে আরম্ভ করে তখন থেকেই নানা উন্মাদনায় পাশে থেকেছে জাজ্বল্যমান দ্যুতি নিয়ে, নিজেকে বিলিয়ে নিজেই উজার হয়েছে, নিষ্পেষিত হয়েছে পায়ের নীচে, এ এক সুখ, বিকৃত উচ্ছ্বাস, পিসাচের অট্টহাসি, অবহেলায় হয়তো ভুলে থাকা যায়- ক্ষণিক সময়, তা-র-প-র রাত হলে, কিংবা রাতের গায়ে জোনাকির পঙ্গর দেখলে আবার ইচ্ছে করে সেখানে ফিরতে, তাদের কাছে যেতে, ঋণবোধ হয়, দিন গড়িয়ে গেলেও অপেক্ষা আর প্রেরণা গলাকাটা গরুর মতোন তরপায়, আর সামনে ছুটতে, এক ছুটে তেপান্তর পার হয়ে আকাশের ওই পাড়ের আকাশ দেখার অনুভূতিতে বারবার হর্ণ করে
ইংরেজি লাইনটানা খাতায় ইংরেজি একটি বর্ণ লেখার বদলে একই সংকুলানে বাংলা শব্দ বিন্যাসে দু’টি লাইন লেখার ঘটনা দুই ক্লাসে থাকতেই সম্পন্ন করার আদেশ যখন পাই তখন সাথে সাথে আজাহার আলী স্যরের পোর্টেট ভাবনায় মূর্ত হয়, দশ নম্বরের পরীক্ষায় আটের নীচে নম্বর পেলে প্যান্টের উপরেই শাস্তি সম্পন্ন হওয়ার বিধান স্বস্তিদায়ক মনে হলেও ছয়ের নীচে নম্বর পেলে প্যান্টের জিপার খুলে প্যান্ট নিচে নামিয়ে তেল চিটচিটে পাছায় বেত্রাঘাতে অপমান ও লজ্জার মিশেলে লাল ডিপডিপে মুখমণ্ডল বন্ধুমহলে বেশ টিটকারির খোরাক হতো, বিষয়টি অর্থাৎ টিউশনি পড়তে যাওয়া যতোটা ভীতির তার চেয়ে দাঁড়িয়ে মুখস্ত বলা ততোধিক সংকোচের, যেনো দণ্ডপ্রাপ্ত ফাঁসির আসামির সামনে বেহালা বাজানো জল্লাদ, টান-উচাটন-অপ্রেম
থাকলেও বাধ্য হয়েই হাজিরা খাতা পূর্ণগর্ভবতী করতে হতো, নতুবা শাস্তি হতো ভিন্ন আঙ্গিকে— একান্তে, এই বিপদাপন্ন পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের মূল হোতা ছিলেন আমার ঈশ্বর, আমার পিতা, যাঁকে আমি আব্বা ডাকি
নানা মতের মিশেলে খাতায় ঝুঁকি নিয়ে উঁকি দেয়া-নেয়ার চুক্তিতে আপন আপন পৃষ্ঠদেশ অন্যদের কাছে রহস্য গল্পের অসমাপ্ত কাহিনি করে রাখতে পাঠ্যতথ্য আদান প্রদানের সমঝোতায় ‘মন’ বিনিময় ঘটে নাজিউল হাসান পিয়ালের সাথে, যাওয়া আসা চলতে থাকে আর আমাদের মনোজগত ‘আমাদের মতো’ গড়িয়ে গড়িয়ে সামনে এগুতে থাকে, পারস্পারিক পড়ার টেবিল থেকে মনের অলিগলি পর্যন্ত, প্রথম দিনই চোখে পড়েছিলো নাজিউলের বাড়ির তিন ফিট আলমারি ভর্তি নজরুলভক্ত সমবয়সী বড় হিমেল ভাইয়ের সংগ্রহের নানা মলাটের বই, হিমেল ভাইয়ের সাথে পরিচিত হবার আকাক্সক্ষা জমিয়ে রেখেছিলাম বহুদিন, নাজিউলের মামাতো ভাই সম্পর্কিত হিমেল ভাই একদিন দীর্ঘ প্রতিক্ষার অবসান ঘটালেন, শোনালেন কবিতা, তার নিজের লেখা, অবাক করার মতো ভাঙচুরের গর্জন অনুভব করেছিলাম সেদিন, তার উপর কারো নিজের লেখা অর্থাৎ জীবিত মানুষের স্বপঠিত কবিতা, তখন ভবনার জগতে ঘুরপাক খেতো— কেবল মৃত ব্যাক্তিরাই কবি হন, যারা কবিতা লেখেন তারা লিখে মারা না যাওয়া পর্যন্ত সেগুলো দিয়ে বই করা হয় না, সেদিন হিমেল ভাই সময়ের জাগরণী সিম্ফোনি বাজিয়েছিলেন কর্ণকুহরে, আরো কী কী সব বই পড়তে বলেছিলেন, ওটা পড়লে সেটা জানতে পারবা, অমুক লেখকের ঘটনার বর্ণনায় কী যে মহুয়া মাতানো ফ্লেবার যার কিছুই তখন জানা হয়নি, হা করে কেবল শব্দ গেলা ছাড়া কিছুই তেমন হয়নি, হ্যাঁ, তবে পরে অনেক আড্ডা হয়েছে, তার সাথেই, তরোর ভিটায়, বাঁশঝাড়ের পাশে কিছু অংশে ছায়া-প্রচ্ছদ বিস্তৃত, তার পরেই পুকুর, তিন মানুষ সমান গর্ত, সারা পাথারের যাবতীয় মাছের আশ্রয়স্থল যেমন ছিল তেমনি ছেলেছোকরাদের মাছশিকারের অভয়ারণ্যও সেটিই ছিল, বন্যার পানি কমে মানুষের অবসরের কাল আসলে তখন মাঝে মাঝে ডাক পড়তো হিমেল ভাইয়ের, এরই মধ্যে টুকটাক বঙ্কিম, নজরুল, রবীন্দ্রনাথ, জসীম উদ্দীন, আহসান হাবীব পড়া হতো সেই তিন ফিট লাইব্রেরি থেকে ধার নিয়ে নিয়ে, ‘বসো, আজ কবিতা লিখছি পাঁচটা, এ্যাকটা এ্যাকটা করে শোনাবো, তার আগে কও তুমি কিছু লিখচো কি না,’ তখন আমার চাচাতো ভাই কাম বেডমেটের কথা তাকে শোনাই, বলি আলমগীর ভাইও তো কবিতা ল্যাখে, হিমেল ভাই তখন বলে, ‘তুমি তো কবির সাথে থাকো তুমিও এ্যাকদিন কবিতা লিখতে পারবা, আচ্ছা কবিতা শোনো’ শুরু হয় কবিতাময় দুপুর, আর সেনর গোল্ডের ধোঁয়ার ঊর্ধ্বমুখী ছুট, মাঝে মাঝে অফার আসলেও স্বসংকোচে ফিরিয়ে দিয়েছি, কখনো স্বাদও নিয়েছি, ওদিকে পাশে বসে থাকা মাছশিকারীরা উসখুশ করে, না সহ্য করতে পেরে একসময় বলেই বসে, ‘ভাই, এ্যাকনা দুরোত য্যায়া আও করো, তোমার কতার চোটোতে মাছ টোপ গেলোচে না,’ তখন হিমেল ভাই আমাকে বলতো, ‘দেখেচো, মাছসকল কবিতা শুনতে আসচে, যা যা মাছ টোপ গেল, কবিতা গিললে তোর জন্ম ব্যর্থ হয়ে যাবে, টোপ গিলে মানুষের টোপে পরিণত হ’
চলতে থাকে ১৮৩২-এ প্রতিষ্ঠা পাওয়া রংপুর জিলা স্কুলে যাবার পাশাপাশি কিছু কিছু গল্প, কবিতা পড়া কিন্তু তা পরিমাণের তুলনায় অনেক অনেক কম, হয়তো পত্রিকার সাপ্তাহিক সাহিত্যিক অংশ কিংবা বড় ক্লাসের বাংলা বই, তারপর একসময় বন্ধুমহল মিলে একপ্রকার বিকৃত উত্তেজনার সাহিত্য-সংবাদ পাই, এক আসঙ্গহীন-সঙ্গ খুঁজতে থাকি, সম্মিলিত প্রচেষ্টায় হাতে আসে রসময় গুপ্ত, মোহনীয় পাঠক আকৃষ্টকরণ ক্ষমতাধর ও রগরগে স্ক্যান্ডাল বর্ণনা করার পাশাপাশি পড়ার নিবিড়তায় মনোনিবেশ করার পারঙ্গমতায় বিশিষ্ট এই সাহিত্য তখন আমাদের আবৃতি যোগ্য পাঠ্য, ডুয়েট আবৃতি হতো তানভীর ইসলাম সারভী আর আমার, দর্শক থাকতো ক্লাস বিরতিতে অবসর কাটানো বেশিরভাগ বন্ধু, যাত্রার টোনে, ‘তুমি ভূমি আমি বীর্যদাতা চাষী, তোমার দেহ মনে আমার বারি বীর্য ঢালি’র মতো ডায়লোগে ক্লাসময় হাততালি পড়তো, সেই বালিশের নিচে লুকানো সাহিত্য ‘এক সময়’ ফিকশনের দিকে আগ্রহী করে তোলে, তখন মাসুদ রানা কিংবা সায়েন্স ফিকশনের জন্যও আমরা চাঁদা তুলি, ঠিক যেমন চাঁদা তুলে যেতাম জাহাজ কোম্পানীর মোড়ের ফুটপাতের দোকানে রসময় গুপ্তকে খুঁজতে অথবা গুপ্তপাড়ার সাইবার ক্যাফেতে নীল চলচ্চিত্র দেখতে
চাচাতো ভাই কাম বেডমেট আলমগীর ভাই, দর্শনের ছাত্র হয়ে এক ডায়রি ভর্তি কবিতা আমার হাতে তুলে দিয়ে বললো, ‘পড়, তুই আমার একমাত্র পাঠক, আর একজন ছিল, সে আর এখন নাই,’ কী বিস্ময়মাখা বেদনা তার কবিতায়, আরো পরে তার লেখা গল্প পড়েছি, কী বাউণ্ডুলে তার গল্পের চরিত্রগুলো, আলমগীর ভাইয়ের বইয়ের তাকে থাকতো নজরুল, শরৎচন্দ্র, শামসুর রাহমানের বই, সেগুলোর মলাটে আমার আগ্রহ ছিল তীব্র, ভেবেছি যারা বড় ক্লাসে পড়ে তারা কবিতা পড়ে, পড়তে হয় উপন্যাস
বক্র-জটিল সময় কচ্ছপ গতিতে পার হলেও বুকে জমিয়ে রেখেছি কিছু অলস স্মৃতি, যে আজাহার স্যরের টিউশনিতে ‘ষড়যন্ত্র’ করে ভর্তি করাতে পারে সেই আব্বা কখনো ক্যানো বাউণ্ডুলে হিমেল ভাইয়ের সঙ্গ ছাড়তে বলেননি, তার উত্তর আজও মেলাতে পারিনি, মাংসের দেয়ালে সোঁদামাটির সুবাস নেওয়ার আগ্রহ ওই প্রচ্ছদ ভালোলাগা থেকেই, কামিজ-কাঁচুলি সাঁটা স্তনের বহিরাবরণের বিপরীতে রহস্যঘেরা সৌন্দর্য অবলোকনে কী যে বিস্ময়, ওই প্রতীক্ষাটুকুন জিইয়ে রেখে বইয়ের মলাট খোলার ধুম, বেড়ে ওঠার মহাবিশ্বে মেঠো আলপথ অতিক্রমকালে হচকিয়ে হোঁচট সামলে ঘুপচি গলিপথ পার হলে বাইপাসের মুখে এসে হাঁটা থেমে যায়নি, হায় পথ, তুমি যার অপেক্ষায় দিন গোনো সে তো আজ সঙ্গ পেয়েছে, কিছুদূর এগুলে পেয়েছি ‘পা’ ও ‘পায়ের চিহ্ন’, হাতে তুলে নিয়েছি, বুকে যতœ করে সাজিয়ে রেখেছি, ‘গুরু’কে পেয়েছি, বহু পথ চলা এখনো বকেয়া থাকলেও ‘ভালবাসা’ হয়েছে, ‘প্রেম’টা এখনো বোঝা হয়নি, হয়তো সেটা আমি বুঝি না তাই বলা হয়নি কখনো, ভেবেছি বলবো-
‘তোমায় যে ভালোবাসি তার/ চিহ্ন তুমি কখনোই খুঁজে পাবে না প্রথাসিদ্ধ নিয়মে’