নব্বুইয়ের দশক
বায়তুল্লাহ্ কাদেরী
যে গন্ধে সন্দেহ ছিল
মরে গেছি জলে, জলে আমি এমনি মরেছি
জলশ্যাওলার আগুনের চিতায় গভীর চোখের
মাছ
হয়তো জিয়েছি, হয়তো জিয়ল হয়ে
লাজুক হয়েছি.. এখানেই শেষ নয়
আমি খুব ক্ষুদে খাদ্যাতির জল
পাছায় পোকার অগ্নি দম দম
নেভে ফের জ্বলে এরকমই ঠাণ্ডা হুতাশন
উত্তরের বায়ুনড়া হু হু হুতাশন-
যেন পোড়ে বাঘের ছায়ার বাদামি পাহাড়,
আর আর্মির সবুজ গন্ধ পোশাকের , মাটির, ঘাঁটির
কিংবা চোখ রাইফেল দিয়ে ভিতরে ঢুকিয়ে দূর ম্যানশন থেকে
জিপের কোমল নারী ফর্সা, স্পা-শেষের ব্লিচ-ত্বক ফর্সা
নারী খুব ফর্সা হাসে কিংবা হেঁটে যায় শাড়ি ঝেড়ে
এইভাবে চোখ শান্তি-মিশনের দূরবীনে
আমাকে করেছে জললোভেী, হস্তীময় দাগি
সন্ত্রাসীর মতন ওরফে ওল্লা, জোল্লা কেল্লা
ঘেটু, পিচ্চি আমাকে করেছে
শব্দচোর, নৃত্যচোর, স্বরচোর আর
গীতিচোর, লোকে হয়তোবা
সে-পায়ের গন্ধই বেশি শুঁকে
যে গন্ধে সন্দেহ ছিল, সন্ধ্যার মতন
ধূসর সন্দেহ শহরের দিকে গেছে
কিংবা নদীতীর ধরে নৌকোর বাতিতে ঘোর
কলিকাল এলো বলে
কলির সন্ধ্যার শুরু… … …
আমাকে বলেছে উতলার এটিও ধরন এক;
এটিও পলির বৈশিষ্ট্যের নিবিড় দেহাবয়ব।
রাশখেলার পরেই একটি কি দুটি হুলির ঘুম
চোখে মুখে কিংবা তাজিয়া যুবক
বুক কেটে ফেলেছে চাকুর তীব্র প্রেমে
…ঘোড়া হারানোর পরে
ইতস্তত ঢোল বেজে গেছে চৈতালির শেষে
ধূলি জমেছিল তানপুরায়.. আশ্বিনে
ধঞ্চে গাছের দিকেই যত পাখি শবে বরাতের মত
পটকা ফাটায়…গেল রাতে দুর্গা চড়েছে সবে পেঁচকের শিরে
পেঁচক-বাহনা সবে আসিতেছে.. পূর্ণিমায় পুচ্ছ
মাঠের বিস্তারে মণ্ডপের চৌতাল অথবা শহরের উঁচু টাওয়ারের খাম্বায়
গুচ্ছের ঢোলক শব্দ রাতের কাহিনী যত ঢুকে গেছে
ঢোলকোলাহলে একবার মুসলিম হয়ে হিন্দু হয়
আরেকবার হিন্দু হয়ে মুসলমান..কখনো কখনো
খ্রিস্টানের মতো হয়ে যেতে থাকে কোট ও ধোপদুরস্ত।
কেকের মধ্যেই শতবৃক্ষের জীবনী পাঠান্তে আবার
কীরকম বাউলের মতো হয়ে যেতে থাকে, বুঝি না,
কিছুই বুঝি না ধুতি…পাগড়ি…বো…টাই… কীরকম গোলমেলে
ক্রিশমাস…ক্রিশমাস… শুধু হয়ে যাও পলির বৈশিষ্ট্যে
গড়ে ওঠো মূর্তিমান ভিতরে ব-দ্বীপে
পলির বৈশিষ্ট্যে
দেখা তো হবেই পথে ঘাটে বিচ্ছিরি ঢঙে
অঙ্গভঙ্গি অতি বিশ্রী আর পুরাতন
দেখা তো হবেই মুখচোরাবেশে
কোথাকার মিচকে শয়তানের মত
আমাদের দেখা তো হবেই
ছোট্ট দুঃখিনী ব-দ্বীপে!
মুজিব ইরম
শারদীয়া : আদি রূপ
তোমাদের বাড়িতে যাবো গো আমি শারদীয়া ভোরে…যেন একটু একটু বৃষ্টি হয়…একটু একটু শীত হয় যেন…যেন একটু একটু কুয়াশা হয় কাশবনে, মনুপাড়ে, দেবীর কৃপায়…পূজামণ্ডপের মাঠে, আরতি নৃত্যের তালে, তোমাকেই আড়চোখে যাচনা করিবো…তোমাকেই অগ্নি ভেবে ধূপধুনি হবো…আমিও বাদক হবো, আমিও নাচিয়ে হবো সুগন্ধি অনলে…সেই শরতসন্ধ্যায় তুমি শুধু একবার দেবী হয়ে ওঠো!
শারদীয়া : উত্তর রূপ
বড়োই খায়েস নিয়ে বাঁচি
শুধু একবার
আরতি নৃত্যের তালে
রোদনামা সন্ধ্যা ঘনঘোরে
তোমাকেই জপে জপে হুঁশহারা হবো…
এই সাজ সাজ মণ্ডপের পাশে আমিও নাচুনে হবো
আমিও অঙ্গার হবো
তোমারই দেহপাত্রে, সুগন্ধি অনলে…
ওহে ঢোলক বাদক
তোমাদের বাদ্যতালে
তোমাদের লাই দেওয়া সুরে
আমি যেন মাটিপাত্রে সুগন্ধি আগুন হয়ে জ্বলি
আমি যেন নারিকেলের ছোবড়া হয়ে সুগন্ধি বিলাই!
আহমেদ স্বপন মাহমুদ
অলৌকিক তলদেশ
অলৌকিক গর্তের ভিতর ঢুকে তুমি হাসছো।
সার্কাস এক আশ্চর্যরকম খেল!
রাতভর শীতার্ত বায়োস্কোপ দেখে
টিকটিকি ও তরল জুসের প্যাক মন ভার করে আছে।
এখনো ভোর হয় নি
অনন্ত রাতের দীর্ঘতম তলদেশ আরো গভীর হচ্ছে।
আর সমস্ত ফায়ার ব্রিগেড, নিষ্পলক ১৬ কোটি মানুষ
সার্কাস ও ক্যামরার মহড়া দেখছে
আমাদের ৬ ফিট মন এক লাফে ৬০০ ফুট
সরলতা নিয়ে উপরে ওঠে ভেলকি দেখছে
উৎকণ্ঠার অলৌকিক পর্দায়।
আমাদের চোখগুলো নিয়ে তামাশা করছে
রেলওয়ে কলোনীর দীর্ঘতম পাইপ;
৬০০ ফুট গভীর হাসি উড়ায়ে তেলাপোকা ঘুরে বেড়াচ্ছে
রাতভর অলৌকিক গর্তে ভেসে বেড়াচ্ছে সরল আকুতি।
আমরা কতদিন হাসি না মা ছয় শ ফুট
আমাদের ভালোবাসা কোনোদিন যেতে পারে নাই ছয় শ ফুট
৬ হাজার বা ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল কোনোদিন পারে নাই যেতে।
আমরা কেবল ১৪৪। ৪ প্লাটুন চতুর রাইফেল।
মা রে, সার্কাস এক আশ্চর্যজনক খেল!
ওবায়েদ আকাশ
রূপনগর
রূপনগর আমার হাত থেকে একদিন কেড়ে নিয়ে গেছে চালতার ব্যাগ। আমার প্রিয় চালতাফুল, যাকে বড় হতে দিয়ে একদিন ছ’টাকায় উঠে পড়ি এই নগরের ট্রেনে; ইলিশ ভাজার ঘ্রাণ, কাগজী লেবু, অথৈ দীর্ঘশ্বাস…এই ফাঁকে মাটির হাঁড়িতে জল, শিং মাছের ঝোল– এই নিয়ে ট্রেনের কামরায় কেউ গান ধরে দিলে ঝিলপাড় থেকে ডগাভাঙা দুবলার কষে কেউ কেউ ধুয়ে নেয় হৃদয়ের ক্ষত। আর তাতে বনমরিচ, বুনো বিছুটির মতো টগবগ করে ছুটে যায় ট্রেন উত্তরের দিকে। আর আমি দুধভরা গাভীর ওলান ভেবে দুই হাতে খুঁজে পাই পুরু ফ্রেমের তলে ফোলা ফোলা চোখের অসুখ। বাঁশবাগান, ঘাসফুল, প্রাচীন হালটের ঢালে বাতাবিলেবুর ফুলে এমন আষাঢ়ের দিনে, একদিন মৌমাছি তুলেছিল বৃষ্টির ভাষা; অথৈ সবুজ থেকে নুয়ে পড়া স্নেহের গভীরে বসে চালতাফুল, ক্রমে তারা ফিরে পায় বহুরঙ মানুষের রূপ। …রূপনগর, এই প্রিয় অভিবাস মুখরতা কোলাহলে ছায়াহীন ভালবেসে বসে আছে অজস্র স্টেশন শেষে
শূন্য দশক
জুয়েল মোস্তাফিজ
আমাদের বাঁশির নাম অ্যাম্বুলেন্স
পণ্ডিত হরিপ্রসাদ চৌরাশিয়া, আপনি যখন অন্তরভেদি বাজাচ্ছেন বাঁশি, ঠিক তখন আমাদের ভূখণ্ডে দিগ্বিদিক ছুটছে অ্যাম্বুলেন্স। আমাদের অ্যাম্বুলেন্সের বাঁশিটা খুব অবুঝ! আপনার বাঁশির মর্ম বোঝে না। প্রাণের বাঁশি পুড়ে গেলে সেই সুরের নাম থাকে না। কেউ কেউ তাকে লাশ বলে। এ এক ভীষণ সুরের ভেদ-আপনার বাঁশি আর আমাদের অ্যাম্বুলেন্স…
প্রিয় চৌরাশিয়া, এমন সময়-এমন করে-কেন বাজালেন? আমরা পুড়ে গেছি, পুড়ে যাচ্ছি, পুড়ে যাব আরো। আমাদের বাঁশির নাম অ্যাম্বুলেন্স, তার গোঙানিতে আমরা আপনার বাঁশি শুনতে পাচ্ছি না…কিছুতেই না। ভোররাতে বাজছে আপনার বাঁশি। আর আমাদের শ্বাসনালির ফুটায় আটকে গেছে বাতাস। আমাদের অ্যাম্বুলেন্সটা বাঁশি বাজতে বাজতে ছুটছে…
অতনু তিয়াস
আমাকে ইচ্ছে করো
লালন বাতাস বহে আরশিনগরে
দূর থেকে উড়ে আসা যাযাবর পাখিগুলো ডানায় ডানায়
আমাকে শুনিয়ে যায় প্রবুদ্ধ সংগীত
একবার তোমার ভেতর যদি অনঙ্গ বউ বলে বেজে উঠতাম একতারা স্বভাবে
বুকের পাথর গলে গলে
একজোড়া নদী হয়ে নেমে যেতো সমতল গ্রাম ছুঁয়ে ছুঁয়ে
আমার এ আজন্ম সাধ কবিতা লেখার
আমার এ আজন্ম সাধ বিবাগী হওয়ার
কাকে যে স্পর্শ করি
কারে যে বুঝাই!
তোমার শরীর বেয়ে উঠে আসা সুগন্ধি সাপগুলো যদি
আরো বেশি দংশনপ্রিয় হয়ে ওঠে
বুকের পৃষ্ঠা দেবো খুলে
মৃত্যুনীল বিষে তবু লেখা হোক একটা কবিতা
অন্তত একবার কবিতা হও মেয়ে
অন্তত একবার আমাকে ইচ্ছে করো
আমাকে ইচ্ছে করো
আলোচনা